সাহিত্য শব্দটা শুনলেই আমার চোখে ভেসে ওঠে কলম ধরা কিছু মানুষ, যাঁরা সত্য বলার চেষ্টা করেন। তাঁদের কথায় থাকে জমানার গন্ধ, সময়ের প্রতিচ্ছবি। আমি বিগত ১৭ বছরের সাহিত্যের পথ চলায় এমন অনেক দৃশ্য দেখেছি, যা আজও মনের মধ্যে দাগ কেটে আছে।
একটা সময় ছিল, যখন সাহিত্যমঞ্চ মানেই নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ছায়ায় আবৃত একটি পরিসর। আমরা অনেকেই সেই সময়ের অংশে ছিলাম। মঞ্চে যারা উঠে কবিতা পড়তেন, গল্প বলতেন, ছোটকাগজ করতেন, তাঁদের প্রায় সবাইকেই আমরা চিনতাম একটি নির্দিষ্ট দলমতের অনুসারী হিসেবে। তখন অন্য দলে থাকা কেউ থাকলেও, তারা নিজেদের অবস্থান প্রকাশ করতেন না। বরং তাদের আচরণ ছিল এমন, যেন তারাও সেই ছাতার নিচেই রয়েছেন।
আমরা দেখেছি কেউ কেউ ছিলেন, যাঁরা আদর্শের প্রশ্নে আপসহীন ছিলেন। তাঁরা সংখ্যায় কম হলেও, তাঁদের চলাফেরায় ছিল একধরনের স্পষ্টতা। তাঁরা কখনোই আমাদের সাহিত্যমঞ্চে আসতেন না, কারণ তাঁদের জন্য এই মঞ্চ ছিল না। কারণ তাঁরা বহুদিন ধরে নিপীড়নের শিকার।
এরপর সময় ঘুরে গেলো।
৫ আগস্টের পর হঠাৎ করেই বদলে গেলো পুরো দৃশ্যপট। এখন যারা সাহিত্যের মঞ্চে রয়েছেন, তাদের মুখে নতুন কথা, কলমে নতুন রং। এক সময় যাদের আমরা চিনতাম অন্য পরিচয়ে, আজ তারা সম্পূর্ণ ভিন্ন ভূমিকার মানুষ। কেউ ফেসবুকে থাকা পুরোনো ছবিগুলো মুছে দিচ্ছেন, কেউ আবার শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করছেন।
(আমার প্রশ্ন একটাই, এই অভিনয়ের দরকারটা কোথায়?)
সাহিত্য কি তবে সুবিধাবাদীদের নাট্যমঞ্চ?
সত্যিই কি একজন খাঁটি সাহিত্যিক সময় বুঝে দল পাল্টায়, মত পাল্টায়?
আমি মনে করি, একজন সাহিত্যিকের কাজ হলো সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো। সরকারের পক্ষে বা বিপক্ষে নয়, বিবেকের পক্ষে। সেই সাহিত্যে রাজনীতি থাকবে, মতাদর্শ থাকবে, তবে তা হবে ব্যক্তিগত। তা কখনোই সাহিত্যের মঞ্চকে কলুষিত করবে না।
আমরা সবাই কোনো না কোনো সময় ভুল পথে হেঁটেছি, সেই ভুল স্বীকার করাও সাহসিকতা। কিন্তু মুখোশ পরে আরেকটা মুখোশের ভেতর ঢুকে গেলে সাহিত্য তার আসল মুখ হারায়।
আজ যারা নিজেদের খাঁটি বলে দাবি করছেন, তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, আপনার কলমটা কি এখনও বিবেকের পক্ষে দাঁড়ায়, নাকি পরিস্থিতির সঙ্গে তাল মিলিয়েই চলে?
আমি চাই না কাউকে ছোট করতে। আমি চাই না কেউ ব্যাখ্যা দিক নিজের অতীতের।
আমি শুধু চাই, আমরা যারা সাহিত্য ভালোবাসি, তারা যেন মুখোশ খুলে দাঁড়াই।
কারণ সাহিত্য কোনো দলের নয়,
সাহিত্য হলো মানুষের।